মহান আল্লাহর তাসবিহ বা প্রশংসা বাক্যের মধ্য সবচেয়ে মর্যাদাবান তাসবিহ হলো- (اللَّهُ أَكْبَرُ) আল্লাহু আকবার। মর্যাদাসম্পন্ন জিকির ও তাকবিরের মধ্যেও এটি সবচেয়ে বড়। এ তাকবিরের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর একান্ত কাছাকাছি হয়। এটি ইসলামের এক বিপ্লবী স্লোগানও বটে।
বিশ্ববিখ্যাত স্কলার ও দাঈ শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসায়মিন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘আল্লাহু আকবার’-এর চমৎকার অর্থ ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘আল্লাহু আকবার’ (اللَّهُ أَكْبَرُ) অর্থ হচ্ছে- হাকিকত এবং আক্ষরিক অর্থে আল্লাহ তাআলা সব কিছুর চেয়ে বড় এবং মহান। তিনি ইলম (জ্ঞান), কুদরাত (ক্ষমতা), সামি (শোনা), বাসির (দেখা) এবং কর্তৃত্বে সব কিছুর চেয়ে বড়। এমনকি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সত্ত্বাগত দিক থেকেও সবচেয়ে বড়। কিন্তু তিনি কত বড়? সাত আসমান এবং সাত জমিন পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার হাতের তালুতে কীসের মতো?
মহান আল্লাহর কাছে এসব (এতোই ছোট); যেন আমাদের কারো হাতের তালুতে একটা সরিষার দানার মতো! কেননা আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেন-
وَ مَا قَدَرُوا اللّٰهَ حَقَّ قَدۡرِهٖ وَ الۡاَرۡضُ جَمِیۡعًا قَبۡضَتُهٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ السَّمٰوٰتُ مَطۡوِیّٰتٌۢ بِیَمِیۡنِهٖ ؕ سُبۡحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ
‘ওরা আল্লাহর যথোচিত কদর করেনি। তেয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী তাঁর হাতের মুঠোয় থাকবে এবং আকাশমন্ডলী থাকবে তাঁর ডান হাতে গুটানো। পবিত্র ও মহান তিনি, ওরা যাকে অংশী করে, তিনি তার উর্ধ্বে।’ (সুরা যুমার : আয়াত ৬৭)
یَوۡمَ نَطۡوِی السَّمَآءَ کَطَیِّ السِّجِلِّ لِلۡکُتُبِ ؕ کَمَا بَدَاۡنَاۤ اَوَّلَ خَلۡقٍ نُّعِیۡدُهٗ ؕ وَعۡدًا عَلَیۡنَا ؕ اِنَّا کُنَّا فٰعِلِیۡنَ
‘সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে ফেলব, যেভাবে গুটানো হয় লিখিত দপ্তর; যেভাবে আমি সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। প্রতিশ্রুতি পালন আমার কর্তব্য; আমি এটা পালন করবই।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১০৪)
লেখকের লেখার পর যেমন কাগজপত্র গুটিয়ে নেওয়া সহজ, তেমনি সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর জন্য আকাশ সুবিস্তৃত হওয়ার সত্ত্বেও তা নিজের হাতের মধ্যে গুটিয়ে নেওয়া কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। তিনি মহান আল্লাহ- ‘আল্লাহু আকবার’।
তাই শায়খ উসাইমিন বলেন, ‘আল্লাহ মহান। আল্লাহ সবকিছুর চেয়ে বড়, যেমন- তাঁর আসমা (সুন্দরতম নামসমূহ) ও সিফাত (সুমহান গুণাবলীতে); একইভাবে তিনি নিজেও সবকিছুর চেয়ে বড়। আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ত্বের প্রকৃত বাস্তবতা অনুধাবন করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা আরশ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, আরশ কত বড় সেটা মানুষের পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, আরশের সৃষ্টিকর্তা (আল্লাহ) কত বড় সেটা বুঝা মানুষের জন্য কতটা সম্ভব! ত্বইয়্যিব!
সুতরাং তুমি যখন বলো- ‘আল্লাহু আকবার’ (اللَّهُ أَكْبَرُ) তখন তুমি এটা অনুভব করবে যে, আল্লাহ সবকিছুর চেয়ে বড়। তিনি ইলম, ক্বুদরত, হিকমত, সমস্ত কাজ পরিচালনার দিক থেকে সবচেয়ে মহান, অনুরূপভাবে তিনি নিজে সমস্ত কিছুর চেয়ে বড়।
যারাই মহান আল্লাহর প্রশংসায় অন্তর থেকে আল্লাহর জন্য এ তাকবির দেবেন; আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও পরকালে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন। কেননা ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির, তাকবিরে তাশরিক ও জিকিরের ফজিলত থেকেই তা প্রমাণিত।
যেসব সময় আল্লাহু আকবার বলতে হয়:
নামাজে তাকবির : আজানের মধ্যে তাকবির বলতে হয়। ঈমানের পর সবচেয়ে যে হুকুম নামাজ। সেই নামাজ শুরু হয় তাকবির তথা আল্লাহু আকবর দিয়ে। তেমনি নবজাতকের কানে তাকবির বলা। মৃত ব্যক্তির জন্য জানাজায় তাকবির বলা ইসলামের বিধান।
চাঁদ দেখে তাকবির : প্রতি মাসে যখন আকাশে নতুন চাঁদ উদিত হয়, তখন তা দেখে তাকবির বলা সুন্নত। নবী (সা.) নতুন চাঁদ দেখার পর বলতেন— اَللّهُّمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالْإِيْمَانِ وَالسَّلاَمَةِ وَالْإِسْلاَمِ رَبِّيْ وِرَبُّكَ الله
উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল-য়ুমনি ওয়াল ঈমানি, ওয়াসসালামাতি ওয়াল ইসলামী, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।
অর্থ : আল্লাহ মহান; হে আল্লাহ, আমাদের জন্য চাঁদটিকে বরকতময় (নিরাপদ), ঈমান, নিরাপত্তা ও শান্তির বাহন করে উদিত করুন। হে নতুন চাঁদ, আল্লাহ তাআলা আমার প্রভু, তোমার প্রভু। (সুনানে দারিমি, হাদিস : ১৭২৯)
হজের সময় : মুসলমানদের পবিত্র তীর্থস্থান বায়তুল্লাহ হজ। সেই পবিত্র ঘর জিয়ারতকালে উচ্চ স্বরে তাকবির বলতে হয়। কঙ্কর নিক্ষেপ করার সময়, আরোহণ করা, নিচে অবতরণ করা, তাওয়াফ করাসহ এ ধরনের সব জায়গাতেই আল্লাহু আকবার বলতে হয়। রাসুল (সা.) বলেন, জিলহজের এই ১০ দিন আল্লাহর কাছে তাকবিরের চেয়ে আর বড় কোনো আমল নেই। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬১৫৪)
ঈদের তাকবির : রমজান ও কোরবানির ঈদের সময় তাকবির বলা। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
সফরে তাকবির বলা : রাসুল (সা.) যখন বাহনে আরোহণ করতেন, তখন তিনি আল্লাহু আকবার বলতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) কোথাও সফরের উদ্দেশে তাঁর উটে আরোহণের সময় তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) বলতেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩১৬৬)
পশু জবাইয়ের সময় : কোনো প্রাণী জবাইয়ের সময় তাকবির বলা। আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) দুই শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো ধুসর রঙের দুটি দুম্বা স্বহস্তে জবাই করেন। (জবাই করার সময়) তিনি ‘বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার’ বলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৯৮১)
আগুন নেভাতে : কোথাও যদি কোনো আগুন লেগে যায় তখন সজোরে আল্লাহু আকবার বলা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোনো জায়গায় আগুন লেগে গেছে দেখো, তখন ‘আল্লাহ আকবার’ বলতে থাকো। কেননা তাকবির আগুন নেভাতে সহায়ক হয়।’ (আমালুল ইওয়ামি ওয়াল লাইলি, হাদিস : ২৮৯)
তাকবিরের খোলে আসমানের দুয়ার : একবার রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ আদায়কালে এক ব্যক্তি বলে উঠল, ‘আল্লাহু আকবার কাবিরা ওয়াল হামদুলিল্লাহ কাসিরা ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতান ওয়া আসিলা’ (অর্থ : আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বড়। সব প্রশংসা আল্লাহর। আর সকাল ও সন্ধ্যায় তারই পবিত্রতা বর্ণনা করতে হবে)। নামাজ শেষে রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এ কথাগুলো কে বলল? সবার মধ্যে থেকে জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ওই কথাগুলো বলেছি। তখন রাসুল (সা.) বললেন, কথাগুলো আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। কারণ কথাগুলোর জন্য আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২৪৫)