কুরআন সর্বজয়ী সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহর বাণী। কুরআনের ভাষা ও বক্তব্য চিরন্তন, চির শাশ্বত ও চিরঞ্জীব। বিশ্ববাসীর কাছে কুরআন এক জীবন্ত মু’জিযা। মানব সমাজের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা শুধুমাত্র আল কুরআনের অনুবর্তন কিংবা প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই নিহিত। এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন-
1. অদৃশ্য স্রষ্টার দৃশ্য বাণী: মানুষ তার স্রষ্টা মহান আল্লাহকে দেখেনা, তিনি অদৃশ্য, তিনি অনুভবের। কিন্তু আমরা তাঁর বাণী পড়ি, দেখি, শুনি। তাঁর বাণী পড়ে আমরা আবেগ আপ্লুত হই। কুরআন আমাদেরকে অনুভব ও বিশ্বাসে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয়। আমরা কথা বলি আমাদের প্রিয় প্রভুর সাথে কুরআনের ভাষায়।
2. অফুরন্ত জ্ঞান ভান্ডার: মহাগ্রন্থ আল কুরআন জ্ঞানের এক অফুরন্ত ফল্গুধারা যা কখনো ফুরায়না। এর জ্ঞান ভান্ডার কখনো অতীতের গর্ভে বিলীন হয়না এবং ভবিষ্যতের আগমনে অকেজো হয়না। সূর্যোলোকের মতো প্রতিদিনই ঘটে এর জ্ঞানের নবোদয়।
3. সত্য অনির্বাণ: একদিকে অবতীর্ণের সূচনা থেকেই কুরআনের সত্যতা ছিলো অনাবিল স্বচ্ছ। অপরদিকে মানব জ্ঞানের পরিধি যতোই বাড়ছে, ততোই প্রকাশিত ও বিকশিত হচ্ছে আল কুরআনের বিস্ময় ও সত্যতা।
4. সার্বজনীন: আল কুরআনের আরেক বিস্ময় হলো এর সার্বজনীনতা। কুরআন বলছে তাকে অবতীর্ণ করা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্যে। বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষী, বিশ্বের সর্বগোত্র, সর্বজাতি, সর্বধর্ম, সর্বভাষা, সর্ববর্ণ এবং সর্বশ্রেণীর নারী কিংবা নর যে-ই কুরআন শুনেছে, পাঠ করেছে এবং হৃদয়ঙ্গম করেছে, সে-ই কুরআনকে হৃদয় দিয়েছে, এর প্রতি ঈমান এনেছে এবং এটিকে গ্রহণ করেছে জীবন যাপনের গাইড বুক হিসেবে।
5. কুরআন কাঁপিয়ে দেয় পাষাণের হৃদয়: আরব কি অনারব, যে-ই মনোযোগ দিয়ে কুরআন পড়ে, বুঝার চেষ্টা করে কুরআনের বক্তব্য, যতোই হোক পাষাণ হৃদয়, কুরআন কাঁপিয়ে তোলে তার সত্তাকে। তারপর বিগলিত করে দেয় তার হৃদয় মন। উমর থেকে নিয়ে আহমদ দীদাত এবং হাজারো আধুনিক মানুষ এর সাক্ষী।
6. কুরআন শত্রুকে করে দেয় আপন: আল্লাহর রসূলের যারা ছিলো জানের শত্রু, কুরআন শুনে কিংবা কুরআন পড়ে তারা হয়ে যায় তাঁর প্রাণের বন্ধু। উমর, আমর, আকরামা এবং খালিদের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) ইতিহাস তো আর ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি। আজো চলছে সেই ধারা। চলবে চিরকাল। এ এক মহাবিস্ময়।
7. ভাষাবিশারদ মহাপন্ডিতেরা সব কুপোকাত: যারা ধারণা করেছিল, কিংবা শত্রুতার বশে বা বিদ্বেষ বশে বলেছিল, কুরআন স্রষ্টার বাণী নয়। এগুলো কোনো কবির শিখিয়ে দেয়া বুলি, কিংবা জিনেরা শিখিয়ে দেয়, কিংবা কোনো ভাষাবিশারদ রাতে এসে মুখস্ত করিয়ে দেয়, কিংবা সবই ম্যাজিক, কিংবা অতীতের কাহিনী; কুরআন তাদেরকে অনুরূপ একটি কুরআন, কিংবা অন্তত একটি সূরা তৈরি করার চ্যালেঞ্জ প্রদান করে। এ চ্যালেঞ্জের সামনে আরবি ভাষার রথি মহারথি কবি পন্ডিতেরা সবাই কুপোকাত।
8. অবিকৃত: কুরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে, আজো হুবহু সেভাবে বর্তমান রয়েছে। দেড় হাজার বছরে এর একটি অক্ষরও বিকৃত হবার প্রমাণ নেই। প্রয়োজন পড়েনি এর একটি বক্তব্যও সম্পাদনা করার, কিংবা সংস্কার করার।
9. সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ: কুরআন পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ কুরআন পাঠ করে। কেউ সালাতে পাঠ করে, কেউ তেলাওয়াত করে, কেউ শিক্ষাদান করে, কেউ অধ্যয়ন করে, কেউ এর দাওয়াত ও প্রচারের কাজ করে, কেউ এর তফসির করে, কেউ গবেষণা করে, কেউ মুখস্ত করে। কুরআনের মতো এতো অধিক পঠিত গ্রন্থ পৃথিবীতে আর নেই।
10. অসংখ্য হাফেযে কুরআন: পৃথিবীতে আল কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যেটিকে প্রতি যুগে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, এমনকি কোটি কোটি মানুষ পূর্ণরূপে স্মৃতিপটে ধারণ করেছেন এবং করছেন। এমনকি শিশুরাও। এই দৃষ্টান্ত অনন্য, অনুপম।
11. সর্বাধিক প্রিয় গ্রন্থ: কুরআন বিশ্বের সর্বাধিক মানুষের সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থ। পৃথিবীতে অনেক পপুলার গ্রন্থ আছে। কিন্তু সেটিকে হুবহু অক্ষরে অক্ষরে নিজের স্মৃতিতে ধারণ করে ক’জনে? কোন্ গ্রন্থের উপর এতো বেশি আলোচনা, গবেষণা হয়? কোন্ গ্রন্থ কুরআনের মতো সারা জীবন বার বার পড়া হয়? একমাত্র কুরআনই সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রিয় গ্রন্থ এবং সর্বাধিক প্রিয় গ্রন্থ।
12. সবচেয়ে মর্যাদাবান গ্রন্থ: বিশ্বাসী লোকেরা কুরআনকে যতোবেশি মর্যাদা দেয়, আর কোনো গ্রন্থের প্রেমিক লোকেরা সেই গ্রন্থকে এতোবেশি মর্যাদা দেয়না। পড়া, বুঝা, জানা, মানা, অনুসরণ করা, শিক্ষা দান করা, প্রচার করা, কার্যকর করা এবং এর আলোকে জীবন ও সমাজ গড়ার কাজ করা -এগুলোই হচ্ছে এ গ্রন্থের প্রতি মর্যাদা দেয়ার উপায়। এরকম মর্যাদা এতো বিপুল মানুষ কর্তৃক আর কোনো গ্রন্থকেই দেয়া হয়না।
13. সুসামঞ্জস্যপূর্ণ পুনারাবৃত্ত বক্তব্য: কুরআনে বিভিন্ন তথ্যপূর্ণ অসংখ্য বক্তব্য দেয়া হয়েছে। তেইশ বছর ধরে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ গ্রন্থে কোনো প্রকার অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য, বক্তব্য, মতামত ও নির্দেশনা নেই। এ এক মহা বিস্ময়কর!
14. শাশ্বত ও সংস্কারমুক্ত: কালের প্রেক্ষাপটে প্রাচীন গ্রন্থাবলি সংস্কার ও সম্পাদনা করা জরুরি হয়ে পড়ে। সংশোধন ও সংযোজন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এর একমাত্র ব্যতিক্রম আল কুরআন। আজ পর্যন্ত বিস্ময়কর ভাবে এর ভাষা ও বক্তব্যে কোনো প্রকার সংস্কার, সংযোজনের প্রয়োজন দেখা দেয়নি।
15. শাশ্বত জীবনের অকাট্য ধারণা উপস্থাপক: কুরআন মানব জীবন সম্পর্কে বস্ত্তবাদী ধারণা ভেঙ্গে চূরমার করে দিয়েছে। কুরআন মানব জীবনকে এক অটুট পূর্ণাঙ্গ ও শাশ্বত জীবন হিসেবে পেশ করেছে। কুরআন বলছে, পার্থিব জীবনে মানুষের যে মৃত্যু হয় তা তার জীবনের মৃত্যু নয়, দৈহিক মৃত্যু। এই মৃত্যুর পরে সে আবার দৈহিকভাবে পুনর্জীবন লাভ করবে। কুরআন আরো বলছে, মানুষের এই পার্থিব জীবনই তার পরকালীন জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার ভিত্তি।
কুরআন প্রদত্ত এই ধারণায় বিশ্বাসীরা তাদের পার্থিব জীবনকে পরকালীন সাফল্যের জন্যে নিয়োজিত করে। বিশ্বাসীরা বিস্ময়করভাবে পারলৌকিক সাফল্যের জন্যে ইহলৌকিক স্বার্থকে ত্যাগ করতে সদা প্রস্ত্তত।
16. সব সমস্যার সমাধান: মহাগ্রন্থ আল কুরআন সব সমস্যার সমাধান। গবেষণার পর গবেষণা চালিয়ে এবং গ্রন্থের পর গ্রন্থ রচনা করে মানুষ তাদের যেসব সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, এই মহাগ্রন্থ মাত্র দুচারটি বাক্যে সেসব সমস্যার সমাধান পেশ করে দিয়েছে।
17. সৃষ্টি যার বিধান তার: মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই মানুষকে আল কুরআন দিয়েছেন জীবন যাপনের ম্যানুয়েল হিসেবে। সুতরাং একমাত্র আল কুরআনই মানুষের জীবন যাপনের সঠিক ব্যবস্থা। কারণ এটা হলো ‘সৃষ্টি যার বিধান তার।’
18. শান্তির পথ মুক্তির পথ: মানবজাতির শান্তি ও কল্যাণের এবং মুক্তি ও সাফল্যের সত্যিকার ফর্মূলা কেবলমাত্র কুরআনেই রয়েছে। কারণ, এটি মানুষের স্রষ্টা সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহর অনির্বাণ আলো। দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত সাফল্য এর মধ্যেই রয়েছে নিহিত।
কুরআন মহাসত্যের আলো
পরম করুণাময় আল্লাহ মানুষের জীবন-দর্শন ও জীবন-যাপন পদ্ধতি হিসেবে নাযিল করেছেন আল কুরআন। এ কুরআনই মহাসত্যের আলো এবং মানুষের শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের একমাত্র গ্যারান্টি। মহান আল্লাহ বলেন:
‘‘আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক আলো (নবী মুহাম্মদ সা.) এবং একটি সত্য ও সঠিক পথ প্রকাশকারী কিতাব, যার দ্বারা আল্লাহ তাঁর সন্তোষ সন্ধানকারীদের শান্তি ও নিরাপত্তার পথ দেখান এবং নিজের ইচ্ছায় তিনি তাদের বের করে আনেন অন্ধকাররাশি থেকে আলোর দিকে, আর তাদের পরিচালিত করেন সরল -সঠিক পথে।’’ (সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ১৫-১৬)
‘‘হে মুহাম্মদ! এটি একটি কিতাব। আমরা এটি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে করে তুমি মানুষকে অন্ধকাররাশি থেকে নিয়ে আসো আলোতে।’’ (সূরা ১৪ ইবরাহিম : আয়াত ১)
কুরআন বুঝা ফরয এবং সহজ
কিন্তু, যে ব্যক্তি কুরআন জানলোনা, বুঝলোনা, তার কাছে তো আলো আর অন্ধকার দুটোই সমান। সুতরাং আলো দেখতে হলে কুরআন বুঝতে হবে। কুরআন না বুঝলে আলোতে আসার সুযোগ কোথায়? আর কুরআন তো বুঝার জন্যে সহজ করেই নাযিল করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
‘‘তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করেনা? নাকি তাদের অন্তরগুলোতে তালা লাগানো রয়েছে?’’ (সূরা ৪৭ মুহাম্মদ : আয়াত ২৪)
‘‘অবশ্যি আমরা এ কুরআন বুঝার জন্যে সহজ করে নাযিল করেছি। অতএব কে আছে এ থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে? (সূরা ৫৪ আল কামার : আয়াত ৪০)
কুরআন মানা ও অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক
যে কোনো বাণীর মতোই কুরআন জানা ও বুঝার সাথে সাথে মানাও জরুরি। মূলত মানা, অনুসরণ করা ও বাস্তবায়ন করার জন্যেই নাযিল করা হয়েছে আল কুরআন। আল্লাহ পাক বলেন:
‘‘আর আমাদের অবতীর্ণ এ কিতাব সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। তাই তোমরা এটিকে অনুসরণ করো, মেনে চলো এবং (এতে প্রদত্ত) নির্দেশ অমান্য করাকে ভয় করো। আশা করা যায় এভাবেই তোমরা (আল্লাহর) অনুকম্পা লাভ করতে সক্ষম হবে।’ (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১৫৫)
‘‘(হে মুহাম্মদ!) আমরা এ মহাসত্য কিতাব তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গোটা মানব সমাজের জন্যে। এখন যে ব্যক্তিই এতে প্রদর্শিত পথের অনুসরণ করবে, তাতে সে নিজেরই কল্যাণ করবে।’’ (সূরা ৩৯ যুমার : আয়াত ৪১)
আপনার বিবেক কী বলে?
আপনি পুরুষ হোন কিংবা মহিলা, আপনার কাজের জন্যে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবেই জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর কাছে। আপনি যে কোনো দৃষ্টিভংগিই পোষণ করুন না কেন, একবার কুরআন পড়ে দেখুন। মুক্ত ও নিরপেক্ষ মনে এ গ্রন্থটিকে অধ্যয়ন করুন। আপনার বিবেক, নিরপেক্ষ মন আর নৈতিক যুক্তি যদি এ মহাগ্রন্থকে সত্য বলে গ্রহণ করে, তবে আসুন, আপনি এ গ্রন্থকে আঁকড়ে ধরুন। বিবেক ও যুক্তিকে সম্মান দিন।
আপনার বিবেক যদি এটিকে সত্য ও বাস্তব বলে গ্রহণ করে, তবে কি আপনার বিবেকের বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক হবে? পৃথিবীতে যতো বই পুস্তক ও যতো গ্রন্থই লেখা হয়, সেটা যে কোনো বিষয়েই লেখা হয়ে থাকনা কেন, তা মূলত লেখা হয় অনুসরণ, বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার জন্যে। ব্যক্তিগত চিঠি থেকে আরম্ভ করে পত্র-পত্রিকা পর্যন্ত সবকিছু থেকেই মানুষ সংবাদ, তথ্য, তত্ত্ব, উপদেশ, সতর্কতা, কর্মনীতি, কর্মপন্থা ও নির্দেশিকা গ্রহণ করে। কিন্তু কুরআনের ব্যাপারটি? কী আচরণ করা হয় কুরআনের সাথে?
আল কুরআন তো মানুষের স্রষ্টা, মালিক ও প্রতিপালক মহান আল্লাহর বাণী। এ বাণীতে তিনি গোটা মানবজাতির জন্যে জীবন যাপনের নির্দেশিকা প্রদান করেছেন। তাই মানুষের কি উচিত নয়, যে কোনো গ্রন্থের চাইতে আল কুরআনকে অধিক গুরুত্ব দেয়া? এটিকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা? অপরিহার্য বিধান হিসেবে গ্রহণ করে এটি পাঠ করা, বুঝা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা? সেই সাথে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল কুরআনের নির্দেশ পালন ও বাস্তবায়ন করা?